বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক সংস্থা ‘বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)’
এর অবস্থান দৃঢ় করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর তদারকি বাড়াতে হবে।
শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া কঠোর এবং নিরপেক্ষ করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় আইন,
নীতিতে সংস্কার করতে হবে। অবকাঠামোগত সংস্কার আনতে হবে। উভয়ক্ষেত্রে
পুনর্গঠন প্রক্রিয়া হাতে নিয়ে বাস্তবায়ন করতে হবে। ইদানীং
বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক দুর্নীতি চোখে পড়ছে বা আলোচনায় আসছে
বাংলাদেশে যে কোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে জনসংখ্যার কথা হিসাবে রাখতে হয়। জনসংখ্যার আধিক্যের কারণে স্বাস্থ্য, শিক্ষা থেকে যোগাযোগ বা নগরায়ণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে মধ্যমেয়াদি বা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ কঠিন হয়ে পড়ে। তাছাড়া আমাদের অসচেতনতাও আছে। বাঙালি হিসেবে আমরা আবেগপ্রবণ। ধৈর্যশক্তি খুবই কম। আমরা শুধু নিজেরটাই বুঝে নিতে চাই। একই ক্ষেত্রে অন্যকে অন্য হিসাবে রাখি। এসব কারণে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কিছুদিন পর আগের হিসাব বা চিন্তাভাবনা মেলে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্ব রেটিংয়ে আমাদের অবস্থা খুবই নাজুক। অনেক সময় হাজারের মধ্যেও ঢাকার মতো বিশ্ববিদ্যালয় আসতে পারে না। অথচ এটাকে একসময় ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ নামেই অভিহিত করা হতো। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থান আরও খারাপ। উন্নতির দিকে বিশ্বের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছে না দেশীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। ক্রমান্বয়ে হেরে যাচ্ছে।
বর্তমানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ১০৫টি। সঙ্গে রয়েছে ৪৯টি সরকারি বা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। মোট শিক্ষার্থী সংখ্যা ১০ লাখের বেশি। এর মধ্যে প্রায় শতকরা ৩৪ ভাগ ছাত্রী। শিক্ষক সংখ্যা প্রায় ২৯ হাজার। সংখ্যাগত বাড়লেও শিক্ষার মান সে অনুপাতে বাড়ছে না! ভালো শিক্ষকের অভাব, গবেষণার সুযোগ অপ্রতুল, বেশিরভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায়িক মনোভাব, শিক্ষক রাজনীতি, শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম প্রভৃতি কারণে শিক্ষার মান কমে যাচ্ছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে থেকেই উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সংকট রয়েছে। স্বাধীনতার পরপরই সংকট আরও বেড়ে যায়। পরবর্তী সময়ে প্রায় ৪০ হাজার শিক্ষার্থী ভারতে পড়াশোনা করতে যায়। দুই হাজার সালের দিকে বিদেশগামী শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য ছিল যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়া। বর্তমানে মালয়েশিয়া যাওয়ার চাপ বেশি। যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্যেও যাচ্ছেন অনেক শিক্ষার্থী। ২০১০ সালে মালয়েশিয়ায় গেছেন দুই হাজারের মতো। কিন্তু গত বছর গেছেন প্রায় ২৮ হাজার। আমাদের দেশে সৃজনশীলতা খুব কমই আছে। উচ্চশিক্ষায় সৃজনশীলতা বাড়াতেই হবে। নতুন জ্ঞানের পরিধি বাড়াতে হবে। পেশাভিত্তিক জ্ঞান বাড়াতে হবে। এসবের সঙ্গে স্নাতক-পরবর্তী সাফল্যও বিবেচনায় আনা হয় বিশ্ব র্যাংকিংয়ে। এগুলোতে চোখ রাখতে হবে; সেটা হতে হবে সুতীক্ষè চোখ। এগুলোতে দুর্বলতার কারণেই বিশ্ব প্রেক্ষাপটে হেরে যাচ্ছি আমরা। শুরুতেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠদানের মান ভালো ছিল। এখনও বেশ কয়েকটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মান খুব ভালো। অন্যগুলোকেও মানোন্নয়ন করতে আন্তরিকতা দেখাতে হবে। এক্ষেত্রে ব্যবসায়িক চিন্তা মাথা থেকে বাদ দেওয়াই ভালো হবে।
ভালো শিক্ষকের পাশাপাশি আরেকটা খারাপ দিক হচ্ছে, উল্লেখযোগ্য হারে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠদানে অনুপস্থিতি। এটার জন্য সাধারণ শিক্ষার্থীরা সময়মতো পাঠদান থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বিশ্বের আর কোনো দেশে এমন ঘটনা হয় কি না আমার জানা নেই। ভালো শিক্ষক পেতে শিক্ষক নিয়োগে স্বচ্ছতা আনতে হবে। শিক্ষক রাজনীতি বন্ধ করতে হবে বা ঢেলে সাজাতে হবে। উপাচার্যদের ক্ষমতা হ্রাস করে ক্ষমতা বণ্টন করতে হবে। গবেষণার জন্য বরাদ্দ বাড়াতে হবে। তদারকি করতে হবে। প্রকাশনার ক্ষেত্রেও বরাদ্দ বাড়াতে হবে। ক্ষমতাপ্রাপ্তদের স্বাধীনতা দিতে হবে। গ্রন্থাগার সমৃদ্ধ করতে হবে। বিভিন্ন ভাষা-জাতির বইয়ের পরিমাণ বাড়াতে হবে। ভালো মানের বই বৃদ্ধি করতে হবে। গ্রন্থাগারগুলো যুগোপযোগী করতে হবে। অনেক সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার ভালো। তবে সংখ্যায় অনেক কম। শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের গবেষণামূলক কাজে উৎসাহিত করতে হবে, প্রণোদনা দিতে হবে। এক্ষেত্রে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে।
ক্যাম্পাসে চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা বাড়াতে হবে। বিনোদনে বৈচিত্র্য আনতে হবে। মফস্বল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নজর দিতে হবে। মফস্বলের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা খুবই খারাপ। বর্তমান সরকার বেশ কিছু কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। ‘হেকেপ’ কর্মসূচি খুবই কার্যকর মনে হচ্ছে। এরকম আরও কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। প্রতি ক্যাম্পাস বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের জন্য ঘন ঘন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের ব্যবস্থা করতে হবে। পত্রিকায় প্রকাশ, আমাদের দেশে অধ্যাপক হওয়া খুবই সহজ। প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিজেদের স্বার্থে বা গ্রুপের স্বার্থে অনেক সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। অথবা রাজনৈতিক তৈলমর্দনে ব্যস্ত হয়। এ থেকে বের হয়ে শিক্ষার্থীদের কল্যাণে সিদ্ধান্ত নিয়ে বাস্তবায়ন করতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক নিম্নমানের ম্যাগাজিন বা সাময়িকী মূলত নিজেদের মুখপত্র হিসেবেই ব্যবহৃত হয়। নিজেদের প্রচারণার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এতে ভালো নিবন্ধ বা গবেষণামূলক কর্মকাণ্ড খুব কমই থাকে। কিন্তু সংখ্যাগত দিক থেকে বেড়েই যাচ্ছে ম্যাগাজিন বা সাময়িকী। বিশ্বের মানে উন্নতি করতে ব্যর্থ হচ্ছি। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচুর গবেষণা হচ্ছে। তার সুফলও আমরা পাচ্ছি। কৃষিক্ষেত্রে অনেক উন্নতি হয়েছে। এক্ষেত্রে গবেষণার ভূমিকা রয়েছে। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বা প্রতিষ্ঠানের গবেষণামূলক কর্মকাণ্ডে বিভিন্ন প্রজাতির শস্য ও ফলে বহুমুখীকরণ করা সম্ভব হয়েছে। অনেক শিক্ষার্থীর প্রতিভা রয়েছে। অনেকে মেলে ধরার অনুকূল পরিবেশ পাচ্ছেন না। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধুর সম্পর্কের অবনতি হচ্ছে ক্রমেই। শিক্ষকদের একাংশের অনেক সময় ধরে পাঠদানে অনুপস্থিতিও একটি কারণ। শিক্ষার মান অবনমনে শিক্ষকদের রাজনৈতিক গ্রুপিং করে বিভক্ত হওয়াও কম দায়ী নয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক সংস্থা ‘বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)’-এর অবস্থান দৃঢ় করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর তদারকি বাড়াতে হবে। শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া কঠোর এবং নিরপেক্ষ করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় আইন, নীতিতে সংস্কার করতে হবে। অবকাঠামোগত সংস্কার আনতে হবে। উভয়ক্ষেত্রে পুনর্গঠন প্রক্রিয়া হাতে নিয়ে বাস্তবায়ন করতে হবে। ইদানীং বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক দুর্নীতি চোখে পড়ছে বা আলোচনায় আসছে। উচ্চশিক্ষায় ঘুরে দাঁড়াতে হলে এগুলো বিবেচনায় আনতেই হবে। বিদ্যমান বৈষম্য দূরীকরণ করার ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য আইন, নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে।
দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের বর্তমান অনুপাত বেশ হতাশাজনকই। দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষককে সর্বোচ্চ ৬২ জন শিক্ষার্থীকে পড়াতে হচ্ছে। তবে কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন শিক্ষক ৫ থেকে ২০ শিক্ষার্থীও পড়াচ্ছেন। শিক্ষা ছুটি ও অন্যান্য কারণে অনুপস্থিত শিক্ষকদের গণনার বাইরে রাখা হলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত আরও বাড়বে। তবে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর আনুপাতিক হার অনুকূল রাখা সম্ভব হলে শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করা সম্ভব হবে বলে মনে করে ইউজিসি। এ অবস্থার মধ্যেই দেশের উচ্চশিক্ষায় একটি ভয়াবহ চিত্র হচ্ছে, বিভিন্ন সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় তিন হাজার শিক্ষকই আছেন শিক্ষা কার্যক্রমের বাইরে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তথ্যানুযায়ী, দেশে বর্তমানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে ৪৫টি। ৫ ধরনের ছুটিতে আছেন বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষক।
ছুটির কারণে বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সংকটে পড়ে। এসব ছুটি বা শিক্ষক অনুপস্থিতির কারণে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ব্যবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এতে সেশনজট বাড়ছে। আর একটি বিষয় হচ্ছে, অনেক শিক্ষক নিজের পূর্ণকালীন চাকরির পাশাপাশি একাধিক খণ্ডকালীন চাকরিতে নিয়োজিত। ফলে তারা যেমন নিজেরা ব্যক্তিগত অধ্যয়নে পর্যাপ্ত সময় পাচ্ছেন না; তেমনি শিক্ষার্থীদেরও যথাযথভাবে শেখাচ্ছেন না বলে অভিযোগ আছে। এর মধ্যে অধিকাংশই শিক্ষা ছুটিতে। প্রেষণ বা লিয়েন নিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা, বিনা বেতনে ছুটিতে, ছুটি শেষ হওয়ার পরও অননুমোদিতভাবে বিদেশে অবস্থান এবং খণ্ডকালীন বা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন কিছু অংশ। অন্য প্রতিষ্ঠানে খণ্ডকালীন চাকরি করেন এমন বাস্তব পরিসংখ্যান নেই। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের হিসাবের সঙ্গে বাস্তবে অনেক ফাঁক আছে বলে মনে করা হয়। এছাড়া বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে এনজিও ব্যবসা, বিদেশি সংস্থায় পরামর্শকসহ বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে খণ্ডকালীন কাজ করছেন অনেকে। এতে পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে। কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ছুটির বিপরীতে শিক্ষক নিয়োগের বিধান আছে। কিন্তু অনেক সময় এ নিয়ম যথাযথভাবে চলে না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের সেবাবঞ্চিত হওয়ার আরেকটি কারণ হচ্ছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকের খণ্ডকালীন বা পূর্ণকালীন চাকরি। বর্তমানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেওয়ার বিষয়টি সবচেয়ে রমরমা। সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকার বাইরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে। সেসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকের চাহিদা পূরণ হয়ে থাকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই। খণ্ডকালীন শিক্ষকদের অভিজ্ঞতা ও আন্তরিকতায় ঘাটতি থাকা স্বাভাবিক। শিক্ষার্থীদের আপন করে নেওয়ার সময়ও পান না অনেকে। ফলে শিক্ষক অনুপস্থিতির প্রধান শিকার হন শিক্ষার্থীরা। ফলে, এক্ষেত্রে উচ্চ শিক্ষা ব্যবস্থায় অচলাবস্থা আসে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর বা অন্য খণ্ডকালীন চাকরি ও গবেষণার সুযোগ প্রায় বিশ্ববিদ্যালয়ই রেখেছে। তবে এ ধরনের চাকরি করলে নিজ প্রতিষ্ঠানকে বাড়তি আয়ের একটি অংশ সার্ভিস চার্জ বা ‘ওভার হেড চার্জ’ হিসেবে দিতে হবে শিক্ষককে। কিন্তু সে অর্থ যাতে জমা দিতে না হয় সে জন্যই অনেক শিক্ষক নিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনুমতিটা পর্যন্ত নেন না। এতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাড়তি আয় থেকে। অন্যদিকে অনেক শিক্ষকের পাঠদান থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। অভিযোগ আছে, ক্লাস ফাঁকি দেওয়া শিক্ষকদের অনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং অবৈধভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকার কাজে পরোক্ষভাবে উৎসাহিত করে থাকে বিভিন্ন গ্রুপ। ‘শিক্ষক রাজনীতি’ অনেকাংশে এ অনৈতিকতার জন্য দায়ী।
আবু আফজাল সালেহ
কলামিস্ট
abuafzalsaleh@gmail.com
সম্পাদকিয়টি প্রথম প্রকাশিত হয় আলোকিত বাংলাদেশ অনলাইন এ
বাংলাদেশে যে কোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে জনসংখ্যার কথা হিসাবে রাখতে হয়। জনসংখ্যার আধিক্যের কারণে স্বাস্থ্য, শিক্ষা থেকে যোগাযোগ বা নগরায়ণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে মধ্যমেয়াদি বা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ কঠিন হয়ে পড়ে। তাছাড়া আমাদের অসচেতনতাও আছে। বাঙালি হিসেবে আমরা আবেগপ্রবণ। ধৈর্যশক্তি খুবই কম। আমরা শুধু নিজেরটাই বুঝে নিতে চাই। একই ক্ষেত্রে অন্যকে অন্য হিসাবে রাখি। এসব কারণে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কিছুদিন পর আগের হিসাব বা চিন্তাভাবনা মেলে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্ব রেটিংয়ে আমাদের অবস্থা খুবই নাজুক। অনেক সময় হাজারের মধ্যেও ঢাকার মতো বিশ্ববিদ্যালয় আসতে পারে না। অথচ এটাকে একসময় ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ নামেই অভিহিত করা হতো। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থান আরও খারাপ। উন্নতির দিকে বিশ্বের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছে না দেশীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। ক্রমান্বয়ে হেরে যাচ্ছে।
বর্তমানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ১০৫টি। সঙ্গে রয়েছে ৪৯টি সরকারি বা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। মোট শিক্ষার্থী সংখ্যা ১০ লাখের বেশি। এর মধ্যে প্রায় শতকরা ৩৪ ভাগ ছাত্রী। শিক্ষক সংখ্যা প্রায় ২৯ হাজার। সংখ্যাগত বাড়লেও শিক্ষার মান সে অনুপাতে বাড়ছে না! ভালো শিক্ষকের অভাব, গবেষণার সুযোগ অপ্রতুল, বেশিরভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায়িক মনোভাব, শিক্ষক রাজনীতি, শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম প্রভৃতি কারণে শিক্ষার মান কমে যাচ্ছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে থেকেই উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সংকট রয়েছে। স্বাধীনতার পরপরই সংকট আরও বেড়ে যায়। পরবর্তী সময়ে প্রায় ৪০ হাজার শিক্ষার্থী ভারতে পড়াশোনা করতে যায়। দুই হাজার সালের দিকে বিদেশগামী শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য ছিল যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়া। বর্তমানে মালয়েশিয়া যাওয়ার চাপ বেশি। যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্যেও যাচ্ছেন অনেক শিক্ষার্থী। ২০১০ সালে মালয়েশিয়ায় গেছেন দুই হাজারের মতো। কিন্তু গত বছর গেছেন প্রায় ২৮ হাজার। আমাদের দেশে সৃজনশীলতা খুব কমই আছে। উচ্চশিক্ষায় সৃজনশীলতা বাড়াতেই হবে। নতুন জ্ঞানের পরিধি বাড়াতে হবে। পেশাভিত্তিক জ্ঞান বাড়াতে হবে। এসবের সঙ্গে স্নাতক-পরবর্তী সাফল্যও বিবেচনায় আনা হয় বিশ্ব র্যাংকিংয়ে। এগুলোতে চোখ রাখতে হবে; সেটা হতে হবে সুতীক্ষè চোখ। এগুলোতে দুর্বলতার কারণেই বিশ্ব প্রেক্ষাপটে হেরে যাচ্ছি আমরা। শুরুতেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠদানের মান ভালো ছিল। এখনও বেশ কয়েকটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মান খুব ভালো। অন্যগুলোকেও মানোন্নয়ন করতে আন্তরিকতা দেখাতে হবে। এক্ষেত্রে ব্যবসায়িক চিন্তা মাথা থেকে বাদ দেওয়াই ভালো হবে।
ভালো শিক্ষকের পাশাপাশি আরেকটা খারাপ দিক হচ্ছে, উল্লেখযোগ্য হারে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠদানে অনুপস্থিতি। এটার জন্য সাধারণ শিক্ষার্থীরা সময়মতো পাঠদান থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বিশ্বের আর কোনো দেশে এমন ঘটনা হয় কি না আমার জানা নেই। ভালো শিক্ষক পেতে শিক্ষক নিয়োগে স্বচ্ছতা আনতে হবে। শিক্ষক রাজনীতি বন্ধ করতে হবে বা ঢেলে সাজাতে হবে। উপাচার্যদের ক্ষমতা হ্রাস করে ক্ষমতা বণ্টন করতে হবে। গবেষণার জন্য বরাদ্দ বাড়াতে হবে। তদারকি করতে হবে। প্রকাশনার ক্ষেত্রেও বরাদ্দ বাড়াতে হবে। ক্ষমতাপ্রাপ্তদের স্বাধীনতা দিতে হবে। গ্রন্থাগার সমৃদ্ধ করতে হবে। বিভিন্ন ভাষা-জাতির বইয়ের পরিমাণ বাড়াতে হবে। ভালো মানের বই বৃদ্ধি করতে হবে। গ্রন্থাগারগুলো যুগোপযোগী করতে হবে। অনেক সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার ভালো। তবে সংখ্যায় অনেক কম। শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের গবেষণামূলক কাজে উৎসাহিত করতে হবে, প্রণোদনা দিতে হবে। এক্ষেত্রে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে।
ক্যাম্পাসে চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা বাড়াতে হবে। বিনোদনে বৈচিত্র্য আনতে হবে। মফস্বল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নজর দিতে হবে। মফস্বলের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা খুবই খারাপ। বর্তমান সরকার বেশ কিছু কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। ‘হেকেপ’ কর্মসূচি খুবই কার্যকর মনে হচ্ছে। এরকম আরও কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। প্রতি ক্যাম্পাস বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের জন্য ঘন ঘন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের ব্যবস্থা করতে হবে। পত্রিকায় প্রকাশ, আমাদের দেশে অধ্যাপক হওয়া খুবই সহজ। প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিজেদের স্বার্থে বা গ্রুপের স্বার্থে অনেক সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। অথবা রাজনৈতিক তৈলমর্দনে ব্যস্ত হয়। এ থেকে বের হয়ে শিক্ষার্থীদের কল্যাণে সিদ্ধান্ত নিয়ে বাস্তবায়ন করতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক নিম্নমানের ম্যাগাজিন বা সাময়িকী মূলত নিজেদের মুখপত্র হিসেবেই ব্যবহৃত হয়। নিজেদের প্রচারণার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এতে ভালো নিবন্ধ বা গবেষণামূলক কর্মকাণ্ড খুব কমই থাকে। কিন্তু সংখ্যাগত দিক থেকে বেড়েই যাচ্ছে ম্যাগাজিন বা সাময়িকী। বিশ্বের মানে উন্নতি করতে ব্যর্থ হচ্ছি। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচুর গবেষণা হচ্ছে। তার সুফলও আমরা পাচ্ছি। কৃষিক্ষেত্রে অনেক উন্নতি হয়েছে। এক্ষেত্রে গবেষণার ভূমিকা রয়েছে। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বা প্রতিষ্ঠানের গবেষণামূলক কর্মকাণ্ডে বিভিন্ন প্রজাতির শস্য ও ফলে বহুমুখীকরণ করা সম্ভব হয়েছে। অনেক শিক্ষার্থীর প্রতিভা রয়েছে। অনেকে মেলে ধরার অনুকূল পরিবেশ পাচ্ছেন না। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধুর সম্পর্কের অবনতি হচ্ছে ক্রমেই। শিক্ষকদের একাংশের অনেক সময় ধরে পাঠদানে অনুপস্থিতিও একটি কারণ। শিক্ষার মান অবনমনে শিক্ষকদের রাজনৈতিক গ্রুপিং করে বিভক্ত হওয়াও কম দায়ী নয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক সংস্থা ‘বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)’-এর অবস্থান দৃঢ় করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর তদারকি বাড়াতে হবে। শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া কঠোর এবং নিরপেক্ষ করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় আইন, নীতিতে সংস্কার করতে হবে। অবকাঠামোগত সংস্কার আনতে হবে। উভয়ক্ষেত্রে পুনর্গঠন প্রক্রিয়া হাতে নিয়ে বাস্তবায়ন করতে হবে। ইদানীং বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক দুর্নীতি চোখে পড়ছে বা আলোচনায় আসছে। উচ্চশিক্ষায় ঘুরে দাঁড়াতে হলে এগুলো বিবেচনায় আনতেই হবে। বিদ্যমান বৈষম্য দূরীকরণ করার ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য আইন, নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে।
দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের বর্তমান অনুপাত বেশ হতাশাজনকই। দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষককে সর্বোচ্চ ৬২ জন শিক্ষার্থীকে পড়াতে হচ্ছে। তবে কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন শিক্ষক ৫ থেকে ২০ শিক্ষার্থীও পড়াচ্ছেন। শিক্ষা ছুটি ও অন্যান্য কারণে অনুপস্থিত শিক্ষকদের গণনার বাইরে রাখা হলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত আরও বাড়বে। তবে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর আনুপাতিক হার অনুকূল রাখা সম্ভব হলে শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করা সম্ভব হবে বলে মনে করে ইউজিসি। এ অবস্থার মধ্যেই দেশের উচ্চশিক্ষায় একটি ভয়াবহ চিত্র হচ্ছে, বিভিন্ন সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় তিন হাজার শিক্ষকই আছেন শিক্ষা কার্যক্রমের বাইরে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তথ্যানুযায়ী, দেশে বর্তমানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে ৪৫টি। ৫ ধরনের ছুটিতে আছেন বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষক।
ছুটির কারণে বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সংকটে পড়ে। এসব ছুটি বা শিক্ষক অনুপস্থিতির কারণে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ব্যবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এতে সেশনজট বাড়ছে। আর একটি বিষয় হচ্ছে, অনেক শিক্ষক নিজের পূর্ণকালীন চাকরির পাশাপাশি একাধিক খণ্ডকালীন চাকরিতে নিয়োজিত। ফলে তারা যেমন নিজেরা ব্যক্তিগত অধ্যয়নে পর্যাপ্ত সময় পাচ্ছেন না; তেমনি শিক্ষার্থীদেরও যথাযথভাবে শেখাচ্ছেন না বলে অভিযোগ আছে। এর মধ্যে অধিকাংশই শিক্ষা ছুটিতে। প্রেষণ বা লিয়েন নিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা, বিনা বেতনে ছুটিতে, ছুটি শেষ হওয়ার পরও অননুমোদিতভাবে বিদেশে অবস্থান এবং খণ্ডকালীন বা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন কিছু অংশ। অন্য প্রতিষ্ঠানে খণ্ডকালীন চাকরি করেন এমন বাস্তব পরিসংখ্যান নেই। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের হিসাবের সঙ্গে বাস্তবে অনেক ফাঁক আছে বলে মনে করা হয়। এছাড়া বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে এনজিও ব্যবসা, বিদেশি সংস্থায় পরামর্শকসহ বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে খণ্ডকালীন কাজ করছেন অনেকে। এতে পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে। কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ছুটির বিপরীতে শিক্ষক নিয়োগের বিধান আছে। কিন্তু অনেক সময় এ নিয়ম যথাযথভাবে চলে না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের সেবাবঞ্চিত হওয়ার আরেকটি কারণ হচ্ছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকের খণ্ডকালীন বা পূর্ণকালীন চাকরি। বর্তমানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেওয়ার বিষয়টি সবচেয়ে রমরমা। সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকার বাইরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে। সেসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকের চাহিদা পূরণ হয়ে থাকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই। খণ্ডকালীন শিক্ষকদের অভিজ্ঞতা ও আন্তরিকতায় ঘাটতি থাকা স্বাভাবিক। শিক্ষার্থীদের আপন করে নেওয়ার সময়ও পান না অনেকে। ফলে শিক্ষক অনুপস্থিতির প্রধান শিকার হন শিক্ষার্থীরা। ফলে, এক্ষেত্রে উচ্চ শিক্ষা ব্যবস্থায় অচলাবস্থা আসে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর বা অন্য খণ্ডকালীন চাকরি ও গবেষণার সুযোগ প্রায় বিশ্ববিদ্যালয়ই রেখেছে। তবে এ ধরনের চাকরি করলে নিজ প্রতিষ্ঠানকে বাড়তি আয়ের একটি অংশ সার্ভিস চার্জ বা ‘ওভার হেড চার্জ’ হিসেবে দিতে হবে শিক্ষককে। কিন্তু সে অর্থ যাতে জমা দিতে না হয় সে জন্যই অনেক শিক্ষক নিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনুমতিটা পর্যন্ত নেন না। এতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাড়তি আয় থেকে। অন্যদিকে অনেক শিক্ষকের পাঠদান থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। অভিযোগ আছে, ক্লাস ফাঁকি দেওয়া শিক্ষকদের অনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং অবৈধভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকার কাজে পরোক্ষভাবে উৎসাহিত করে থাকে বিভিন্ন গ্রুপ। ‘শিক্ষক রাজনীতি’ অনেকাংশে এ অনৈতিকতার জন্য দায়ী।
আবু আফজাল সালেহ
কলামিস্ট
abuafzalsaleh@gmail.com
সম্পাদকিয়টি প্রথম প্রকাশিত হয় আলোকিত বাংলাদেশ অনলাইন এ
Tags
সম্পাদকীয়